রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:০২ অপরাহ্ন
#শুক্রবারের_গল্প
আমি তো ঘরেই ছিলাম
#মনদীপ_ঘরাই
আহা, শান্তি!আজ বহুদিন পর ঘর থেকে বের হলাম। গত পাঁচটা বছর ঘরেই ছিলাম। একই ঘরে,ছোট একটা খাটে আটকে ছিলো আমার পুরোটা জগত। এমন তো ছিলো না আমার জীবন! ছোটখাটো একটা চাকরি করতাম পোস্ট অফিসে। দৈনিক সময় মতো অফিসে যেতাম। মানুষের দুয়ারে ভালো-মন্দ খবর আর মানি অর্ডার পৌঁছে দিতাম। তারপর একদিন সময় তার ঘন্টা বাজিয়ে বললো, এবার থামতে হবে। ৩২ বছরের চাকরি শেষে অবসর নিলাম নীরবে। আরে ধুর। ওসব আবেগী চিন্তা বাদ দিন।ডাকপিয়নদের জন্য কখনো বিদায় অনুষ্ঠান-ফনুষ্ঠান হয় না।
পুরো চাকরি জীবনেই মাঝে মাঝে মনে হতো, একটু অবসর দরকার, ছুটি দরকার। সত্যি বলতে কী, এখন অবসরে এসে বুঝতে পারছি…মানুষের দরকার কাজ। আর কিচ্ছু দরকার নেই জীবনে। এই কাজের অভাবেই অবসর জীবনটাতে শরীরে বাসা বাঁধতে থাকলো একের পর এক রোগ। তবুও চলেফিরে খেতে তো পারতাম তখনো। বছর পাঁচেক আগে আমার স্ত্রী বাথরুমে পা পিছলে পড়ে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যান। এত বড় শোক সহ্য করা আমার জন্য অসম্ভব ছিলো। যা হবার তাই হলো। স্ট্রোক করে বিছানায় এঁটে গেলাম পাকাপোক্তভাবে।প্যারালাইসিস।
থাক থাক। রোগের গল্প আর করবো না। আমার নিজের ছেলে-মেয়েরাই বিরক্ত হয় রোগের কথা শুনলে, আর আপনারা তো বাইরের মানুষ।
বাইরের মানুষদের আমার বড় ঈর্ষা হয়। একদিন আমিও তো বাইরের মানুষ ছিলাম। মানুষের চিঠি নিয়ে কবুতরের মতো উড়ে বেড়াতাম এ পাড়া থেকে ও পাড়া, এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম।
এখনও ভাবনাতে উড়ে বেড়াই অতীতের সেই সব গ্রামে। মনে মনে চিঠি পৌঁছে দেই সবাইকে।
বিছানায় শুয়ে থাকা আমার দিনগুলোতেও অনেক বৈচিত্র্য আছে, জানেন?
সকালে রোদের দিকে তাকিয়ে ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে দেই অনায়াসে। বৃষ্টির দিনে মন ভরে দেখি বৃষ্টি। আর শীতের দিনে দেখি কুয়াশা। দেয়াল ঘড়িটা সারাদিন আমার সাথে কথা বলে। ওর ভাষা যদিও টিক টিক শব্দেই সীমাবদ্ধ, তবুও আমি বুঝতে পারি স্পষ্ট। দুপুরের দিকে জানালায় একটা কাক আসে। ওর সাথেও কথা বলি। সুবিধা হলো, কেউ কারো কথা বুঝি না। বুঝলে হয়তো ওরাও আমার নাতিদের মতো দৌঁড়ে পালাতো নির্ঘাত।
সারাদিন বাসায় কেউ থাকে না। সবাই ব্যস্ত। ছেলে ব্যস্ত, বউমা ব্যস্ত, নাতিদের স্কুল, কোচিং…
সন্ধ্যায় সবাই বাসায় থাকে, তবে আমার কাছে তেমন একটা কেউ আসে না। শুধু খাবার আর ওষুধ দিতে…
তবু সবাই বাসায় থাকলে ওটুকুই ভালো লাগে। ইস! সবাই যদি সারাক্ষণ বাসায় থাকতো!
গত আড়াই মাস আগে কোন অদ্ভুত কারণে সৃষ্টিকর্তা আমার প্রার্থনা গ্রহণ করেছেন। কি একটা ভাইরাস আসাতে সবাই বাসাতেই থাকছে। আমার মতোই কারো কোন কাজ নেই। বাসার মধ্যেই কাটছে সবার দিন-রাত।
টিভি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে কখনো ছেলে, কখনো বউমা, আর কালেভদ্রে নাতিরাও এখন আমার কাছে এসে বসে। দু একটা কথাবার্তাও বলে। সত্যিই আমার আনন্দের সীমা নেই। খুব স্বার্থপর চিন্তা, তারপরেও এভাবেই ভালো লাগছে বহুদিন পর।
তবে, সুখ ব্যাপারটা কখনই বেশিদিন সয় না আমার কপালে। এবারেও ব্যতিক্রম হলো না। সবাই বাসাতেই রয়ে গেলো। আমি বেরিয়ে এলাম মুক্ত আকাশের নিচে।
আজ বহুদিন পর ঘর থেকে বের হলাম। একটা গাড়িতে করে কোথায় যে যাচ্ছি বুঝতে পারছি না। নিঃশ্বাসও নিতে পারছি না। খুব করে খুঁজেছি আমার ছেলে-বৌমাদের। কেউ নেই। সাথে চার পাঁচজন অপরিচিত লোক। সাদা সাদা কেমন যেন পোশাক পড়া। দুপুরের কোন একটা সময় বুঝতে পারলাম, আমি নেই। থেমে গেছি সেই অচেনা ভাইরাসের ছোবলে। আমি নাকি বড় বেশি ছোঁয়াচে হয়ে গেছিলাম; তাই ছেলেরা কেউ আসে নি।
তাহলে এই অপরিচিত মানুষগুলো এলো কেনো!
আমার খুব ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছে।
আমি তো ঘরেই ছিলাম। আমি তো ঘরেই ছিলাম।
এখন…আমি আর কোথাও নেই।